আহ্মদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্, আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৪ঠা মার্চ, ২০২২ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় সাম্প্রতিক ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় হযরত আবু বকর (রা.)’র ধারাবাহিক স্মৃতিচারণের ধারা অব্যাহত রাখেন রাখেন। খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) পৃথিবীর বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বিশেষভাবে দোয়ার আহ্বান জানান এবং সম্প্রতি প্রয়াত কতিপয় নিষ্ঠাবান আহমদীর স্মৃতিচারণ করেন ও নামাযান্তে তাদের গায়েবানা জানাযা পড়ান।
তাশাহ্হুদ, তাআ’ঊয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)’র খলীফা নির্বাচিত হবার ব্যাপারে যে তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল- সে বিষয়ে তারীখে তাবারীর একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেন। হযরত হুবাব বিন মুনযের আনসারী (রা.) অন্য আনসারদেরকে খিলাফতের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে রাখার ব্যাপারে খুব জোরালো বক্তব্য প্রদান করেন। তার মতে, মুহাজিররা যেহেতু তখন তাদেরই শহরের বাসিন্দা, তাই তারা বেশি উচ্চবাচ্য না করে সবাই আনসারদের সিদ্ধান্ত মেনে নেবে। তাছাড়া প্রভাব-প্রতিপত্তি, সহায়-সম্পদ, সংখ্যাধিক্য, শক্তি-সাহসিকতা, রণনৈপুণ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে তারাই এগিয়ে আছেন। এরপরও যদি মুহাজিররা অস্বীকৃতি জানায়, তবে মুহাজির ও আনসার উভয় দলের মধ্য থেকে দু’জন খলীফা হবেন। হযরত উমর (রা.) দৃঢ়ভাবে তার কথা খণ্ডন করে বলেন, এটি কখনোই সম্ভব না, কারণ এক খাপে দু’টো তরবারি থাকতে পারে না। তাছাড়া আরবের বাসিন্দারা মহানবী (সা.)-এর খলীফা কেবল সেই গোত্র থেকে হলেই মানবে, যাদের মাঝে তিনি (সা.) স্বয়ং আবির্ভূত হয়েছেন; আর যদি কেউ তা অস্বীকার করে তবে তার বিরুদ্ধে মুসলমানদের হাতে অকাট্য যুক্তি ও সত্য রয়েছে। হযরত হুবাব বিন মুনযের (রা.) তারপরও তর্ক চালিয়ে যেতে থাকেন এবং হযরত উমর (রা.) তাকে উত্তর দিতে থাকেন। তখন হযরত আবু উবায়দাহ্ (রা.) আনসারদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা সবার আগে ইসলামের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিলে; এটি একেবারেই অনুচিত হবে যদি তোমরাই আজ সর্বাগ্রে তাত্থেকে বিচ্যুত হও। তখন আনসারী সাহাবী হযরত বশীর বিন সা’দ (রা.) বলেন, মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ ও ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় যে সেবার সৌভাগ্য তারা লাভ করেছেন, তা আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টি লাভ ও তাঁর রসূলের আনুগত্যের খাতিরে করেছেন। অন্যদের ওপর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা তাদের উদ্দেশ্যে হওয়া উচিত নয়। ধর্মসেবার সেই সুযোগ আল্লাহ্ তা’লারই মহান দান ছিল। তিনি মুহাজিরদেরকেই খিলাফতের যোগ্য দাবীদার বলে স্বীকার করেন। অন্যান্য ইতিহাসগ্রন্থের বর্ণনামতে, এরপর হযরত উমর (রা.) খলীফা হিসেবে হযরত আবু বকর (রা.)’র নাম প্রস্তাব করেন এবং সূরা তওবার ৪০নং আয়াতের উল্লেখ করে বলেন, এই তিনটি বৈশিষ্ট্য কার ছিল যিনি রসূল (সা.)-এর সাথী ছিলেন, তাঁর (সা.) সাথে গুহায় অবস্থান করছিলেন এবং মহানবী (সা.)-এর মত তার সাথেও আল্লাহ্ আছেন? একথা বলে হযরত উমর (রা.) হযরত আবু বকর (রা.)’র হাতে বয়আ’ত করেন ও অন্যদেরকেও বয়আ’ত করতে আহ্বান জানান। তখন প্রথমে হযরত আবু উবায়দাহ্ বিন জাররাহ্ (রা.)ও হযরত বশীর বিন সা’দ (রা.) এবং তারপর উপস্থিত বাকি আনসারগণও একে একে বয়আ’ত করেন। ইসলামের ইতিহাসে এটি বয়আ’তে সাকীফা ও বয়আ’তে খাস্সা নামেও সুপরিচিত। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)ও এই ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন যা হুযূর (আই.) উদ্ধৃত করেন। হযরত সা’দ বিন উবাদাহ্ (রা.)’র বয়আ’ত গ্রহণ সম্পর্কে ইতিহাসগ্রন্থগুলোতে মতভেদ রয়েছে; কোন কোন বর্ণনায় তার বয়আ’ত না করার উল্লেখ রয়েছে, আবার কিছু বর্ণনায় বয়আ’ত করার উল্লেখ রয়েছে। তারীখে তাবারীর মতে তিনি বয়আ’ত করেছিলেন।
ইতিহাস পাঠে জানা যায়, মহানবী (সা.) সোমবার মৃত্যুবরণ করেন এবং সেদিনই বয়আ’তে সাকীফা অনুষ্ঠিত হয়; অবশিষ্ট দিন ও মঙ্গলবার সকালে মসজিদে গণ-বয়আ’ত অনুষ্ঠিত হয়। হযরত উমর (রা.) তখন সবার উদ্দেশ্যে বয়আ’তের আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। স্বয়ং হযরত আবু বকর (রা.)ও সেদিন একটি খুতবা দেন; সেই খুতবায় তিনি বিনয়ের পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে বলেন, “যদিও আমাকে তোমাদের অভিভাবক বানানো হয়েছে, কিন্তু আমি তোমাদের মাঝে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি নই। যদি আমি আল্লাহ্ ও রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর আনুগত্য করি, তবে তোমরা আমার আনুগত্য করো; যদি তা না করি তবে তোমাদের জন্য আমার আনুগত্য আবশ্যক নয়”। এটি একান্তই তার বিনয় ছিল, নতুবা খলীফা আল্লাহ্ ও রসূলের অনুগত হবেন না তা কখনোই সম্ভব নয়। হযরত আলী (রা.)’র বয়আ’ত গ্রহণ সম্পর্কে জানা যায়, যখন তাকে কেউ একজন সংবাদ দেন যে, হযরত আবু বকর (রা.) মসজিদে বয়আ’ত নিচ্ছেন, তিনি তৎক্ষণাৎ বয়আ’ত নিতে ছুটে যান, তখন তার পরনে কেবল একপ্রস্থ কাপড় ছিল। অর্থাৎ, পুরো পোশাক পরার বিলম্বটুকুও তিনি করেন নি। কতক বর্ণনামতে তিনি ছ’মাস পর্যন্ত বয়আ’ত করেন নি, বরং হযরত ফাতেমা (রা.)’র মৃত্যুর পর বয়আ’ত করেন। তবে অন্যান্য বর্ণনা এবং বিশেষভাবে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ভাষ্য থেকে বুঝা যায়, তিনি ত্বড়িৎ বয়আ’ত গ্রহণ করেছিলেন। হযরত আবু বকর (রা.)’র পিতা আবু কুহাফা যখন প্রথমে তাঁর খিলাফতের কথা শোনেন, তখন তিনি বিশ্বাসই করতে পারেন নি। পুরো বৃত্তান্ত শোনার পর অবলীলায় তার মুখ থেকে ইসলামের সত্যতার সাক্ষ্য উচ্চারিত হয়; কারণ ইসলামের কল্যাণেই হযরত আবু বকর (রা.) একজন সাধারণ মানুষ হয়েও এই মহান সম্মান লাভ করেছেন।
মহানবী (সা.) স্বপ্ন দেখেছিলেন যা হযরত আবু বকর (রা.)’র খিলাফতের প্রতি ইঙ্গিতবহ ছিল। স্বপ্নে তিনি (সা.) দেখেছিলেন যে, তিনি কূঁপ থেকে পানি তুলছেন, এরপর আবু বকর এসে বেশ কষ্টে দু’বালতি পানি তোলেন; এরপর উমর এগিয়ে এলে বালতি বড় হয়ে যায় এবং তিনি এত বেশি পানি তোলেন যে, সবাই তা পান করে পরিতৃপ্ত হয়। হযরত আবু বকর (রা.) নিজেও একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, তিনি দু’প্রস্থ ইয়েমেনি কাপড় পরে আছেন, যার বুকের কাছে দু’টি দাগ ছিল। মহানবী (সা.) দু’টি দাগের ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, আবু বকর দু’বছর মুসলমানদের আমীর থাকবেন।
হযরত আবু বকর (রা.) খিলাফতের আসনে সমাসীন হবার পর সুনাহ্ থেকে মদীনায় স্থানান্তরিত হন। যেহেতু খিলাফতের গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তার ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না, তাই সংসারের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য তিনি হযরত উমর (রা.)’র পরামর্শে বায়তুল মাল থেকে নিয়মিত ভাতা গ্রহণে সম্মত হন। কিন্তু যখন তার অন্তিমকাল উপস্থিত হয়, তখন তিনি তার নির্দিষ্ট কিছু জমি বিক্রি করে বায়তুল মাল থেকে গ্রহণকৃত সমুদয় অর্থ ফেরত দিতে নিজ আত্মীয়দের নির্দেশ দেন। হযরত উমর (রা.) খলীফা নির্বাচিত হলে যখন তার কাছে সেই অর্থ উপস্থাপন করা হয়, তখন তিনি কেঁদে ফেলেন এবং বলেন, “হে আবু বকর সিদ্দীক, আপনি পরবর্তী খলীফাদের ওপর অনেক কঠিন দায়িত্ব অর্পণ করে গেলেন”! খোলাফায়ে রাশেদীনদের মধ্যে হযরত আবু বকর (রা.)’র খিলাফতকাল সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ছিল, মাত্র দুই বা সোয়া দুই বছর তিনি খলীফা ছিলেন। কিন্তু তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সোনালী এক অধ্যায় ছিল, কারণ তাকে সবচেয়ে বেশি কঠিন ও ভীতিসংকুল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল; কিন্তু আল্লাহ্ তা’লার অসাধারণ সাহায্য ও কৃপায় হযরত আবু বকর (রা.)’র অসম সাহসিকতা ও গভীর ধীশক্তির মাধ্যমে দ্রুত তা শান্তি ও নিরাপত্তায় বদলে যায়। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রা.) পিতার খিলাফতকালের কঠিন অবস্থা সম্পর্কে বলেন, তার ওপর যেসব বিপদাপদ আপতিত হয়েছিল তা যদি পাহাড়ের ওপরও পড়তো, তবে তা মাটির সাথে মিশে যেতো; কিন্তু তাকে রসূলদের মত ধৈর্য দান করা হয়েছিল এবং আল্লাহ্র সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে তিনি সব বিশৃঙ্খলা দূর করেন। হযরত আবু বকর (রা.)-কে খিলাফতের প্রারম্ভেই পাঁচ প্রকার দুঃখ ও বিপদের সম্মুখীন হতে হয়; মহানবী (সা.)-এর মৃত্যু ও বিচ্ছেদের কঠিন বেদনা, খিলাফতের নির্বাচন নিয়ে উম্মতের মাঝে বিভেদের শংকা, উসামার বাহিনী রওয়ানা করার বিষয়, মুসলমানদের একাংশের যাকাত দিতে অস্বীকৃতি ও মদীনায় আক্রমণের শংকা, মুরতাদ ও মিথ্যা নবুয়্যতের দাবীকারকদের বিদ্রোহ ও যুদ্ধের হুমকি। হুযূর (আই.) বলেন, ভয়ভীতির এই সময়ে শত্রুদের দমন ও বিপদাপদ দূরীকরণে আল্লাহ্ তা’লা হযরত আবু বকর (রা.)-কে যে সাফল্য দান করেন তা পরবর্তীতে সবিস্তারে উল্লেখ করা হবে, ইনশাআল্লাহ্। এর পূর্বে হুযূর (আই.) এই যুগে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে প্রেরিত হাকাম ও আদল তথা ন্যায়বিচারক ও মীমাংসাকারী হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি উপস্থাপন করেন, যেখানে তিনি (আ.) হযরত আবু বকর (রা.)-কে হযরত মূসা (আ.)-এর প্রথম খলীফা হযরত ইউশা বিন নূন (রা.)’র সদৃশ আখ্যা দিয়ে তার মাধ্যমে উদ্ভূত সমস্যাবলীর সমাধান ও বিজয়ের সূচনার বর্ণনা করেছেন। তিনি (আ.) সূরা নূরের ৫৬নং আয়াত তথা আয়াতে ইস্তেখলাফের উল্লেখ করেন যাতে মূসায়ী ধারার খিলাফতের সাথে মুহাম্মদী ধারার খিলাফতের সাদৃশ্য বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর তিনি হযরত ইউশা বিন নূন (রা.)’র সাথে হযরত আবু বকর (রা.)’র সাদৃশ্যগুলো একাধারে তুলে ধরেন এবং একইসাথে আয়াতে ইস্তেখলাফে বর্ণিত আল্লাহ্ তা’লার প্রতিশ্রুতিও কীভাবে আবু বকর (রা.)’র মাধ্যমে পূর্ণ হয়েছে তা তুলে ধরেন। মূসা (আ.)-এর মৃত্যুর পর যেভাবে হযরত ইউশা (রা.) সর্বপ্রথম তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, তদ্রুপ মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর হযরত আবু বকর (রা.)ও সবার আগে তা উপলদ্ধি করেন। যেভাবে হযরত মূসা (আ.)-এর মৃত্যুর পর অনেক বিপদাপদ ও ভীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল আর হযরত ইউশার (রা.)মাধ্যমে আল্লাহ্ এত্থেকে তার উম্মতকে উদ্ধার করেন, তেমনি হযরত আবু বকর (রা.)’র ক্ষেত্রেও ঘটেছে। হুযূর (আই.) তা সবিস্তারে উল্লেখ করেন।
খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) বর্তমানে পৃথিবীতে বিরাজমান যুদ্ধ-পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে জামা’তকে বিশেষভাবে দোয়া করার আহ্বান জানান এবং বেশি বেশি দরূদ শরীফ পাঠ ও ইস্তেগফার করার উপদেশ দেন। সেইসাথে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর একটি বিশেষ নির্দেশনাও জামা’তকে পালন করতে বলেন; তা হল নামাযের রুকু থেকে দাঁড়িয়ে رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ দোয়াটি বেশি বেশি পাঠ করা। হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদের হাসানাত বা কল্যাণরাজি দ্বারা ভূষিত করুন এবং সবরকম আগুনের আযাব থেকেও সবাইকে রক্ষা করুন। এরপর হুযূর (আই.) সম্প্রতি ৯০ বছর বয়সে প্রয়াত সিরিয়ার অত্যন্ত নিষ্ঠাবান আহমদী শ্রদ্ধেয় আবুল ফারাজ আল্ হাসানী সাহেবের গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন ও তার সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন। হুযূর (আই.) মরহুমের অসাধারণ পুণ্যরাজি, খিলাফতের প্রতি তার অগাধ নিষ্ঠা, শ্রদ্ধা ও আনুগত্যসহ বিভিন্ন অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেন এবং তার রূহের মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করে দোয়া করেন।