আহ্মদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্, আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৩ই মে, ২০২২ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় সাম্প্রতিক ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় হযরত আবু বকর (রা.)’র ধারাবাহিক স্মৃতিচারণের ধারা অব্যাহত রাখেন রাখেন এবং সশস্ত্র বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে হযরত খালিদ (রা.)’র নেতৃত্বে প্রেরিত বিভিন্ন যুদ্ধাভিযান সম্পর্কে আলোচনা করেন।
তাশাহ্হুদ, তা’ঊয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন,, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)’র যুগে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা দমনের লক্ষ্যে প্রেরিত বিভিন্ন যুদ্ধাভিযান সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল। এ প্রসঙ্গে হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ (রা.)’র বুতাহ্ অঞ্চলে মালেক বিন নুওয়াইরার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার বিস্তারিত বিবরণ হুযূর (আই.) তুলে ধরেন। ‘বুতাহ্’ বনু আসাদ গোত্রের অঞ্চলের একটি ঝরনার নাম। মালেক বিন নুওয়াইরা বনু তামীম গোত্রের শাখা বনু ইয়ারবু’র সদস্য ছিল। সে ৯ম হিজরীতে নিজ গোত্রের সাথে মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেছিল; সে আরবের নামকরা অশ্বারোহী ও বীরদের একজন ছিল। মহানবী (সা.) তার ওপর নিজ গোত্রের যাকাত আদায় করার দায়িত্ব অর্পণ করেন। কিন্তু মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর আরবে যখন মুরতাদ হওয়ার হিড়িক পড়ে তখন সে-ও মুরতাদ হয়ে যায়। মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুতে সে আনন্দোৎসব উদযাপন করে; তার বাড়ির নারীরা মেহেদী লাগিয়ে, ঢোলবাদ্য বাজিয়ে খুব আনন্দ-উল্লাস করে। তারা তাদের গোত্রের সেসব মুসলমানকে হত্যাও করেছিল যারা যাকাত আদায় করা এবং তা মদীনায় প্রেরণ করাকে আবশ্যক জ্ঞান করতেন। হুযূর (আই.) বলেন, একথা ভালোভাবে মনে রাখতে হবে- যাদেরই শাস্তি দেয়া হয়েছিল বা যাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল তারা শুধু মুরতাদই ছিল না, বরং মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে সচেষ্টা ছিল। মালেক যাকাত প্রেরণে বাধা দেয় এবং তা স্বগোত্রের লোকদের মাঝে বিলিয়ে দেয়। সেইসাথে সে নবুয়্যতের মিথ্যা দাবীকারী সশস্ত্র বিদ্রোহী সাজাহ্ বিনতে হারেসের দলেও যোগ দেয়, যে অনেক বড় একটি সৈন্যদল নিয়ে মদীনা আক্রমণ করতে এসেছিল বা মতান্তরে আক্রমণ করতে চেয়েছিল।
সাজাহ্ একজন জ্যোতীষি, মিথ্যা নবুয়্যতের দাবীকারী ও বিদ্রোহী গোত্রের নেত্রী ছিল। মূলত সে বনু তামীম গোত্রের সদস্যা ছিল এবং মায়ের দিক থেকে বনু তাগলাব গোত্রের সদস্যা ছিল যারা অধিকাংশই ছিল খ্রিস্টান। সাজাহ্ নিজেও খ্রিস্টান ছিল এবং খ্রিস্টধর্মের বড়মাপের এক আলেম নারী ছিল। সে ইরাক থেকে নিজ অনুসারীদের নিয়ে এসেছিল ও মদীনায় আক্রমণের সংকল্প রাখতো। কতক ঐতিহাসিকের মতে সে ইরানীদের ষড়যন্ত্রের অধীনে আরবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে এসেছিল। আরবে এসে স্বভাবতই সে নিজ গোত্র বনু তামীমের কাছে যায়। বনু তামীমের একটি অংশ যাকাত প্রদান ও মহানবী (সা.)-এর খলীফার আনুগত্যের পক্ষপাতি ছিল, আরেকটি অংশ তাদের বিরোধী ছিল; তৃতীয় একটি দল এমন ছিল- যারা তাদের করণীয় কী তা বুঝে উঠতে পারছিল না। ফলে বনু তামীম নিজেদের ভেতরেই হানাহানি ও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এর মাঝে সাজাহ্র আগমন বিষয়টিকে আরও জটিল করে তোলে। সাজাহ্ গিয়ে বনু ইয়ারবু’র সীমানায় শিবির স্থাপন করে এবং গোত্রের নেতা মালেক বিন নুওয়াইরাকে ডেকে সন্ধির ও একযোগে মদীনা আক্রমণের প্রস্তাব দেয়। মালেক সন্ধির প্রস্তাব গ্রহণ করলেও মদীনা আক্রমণ না করার পরামর্শ দেয় এবং বলে, মদীনা আক্রমণের চেয়ে নিজ গোত্রে থাকা তাদের বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের দমন করাই উত্তম হবে। সাজাহ্ও একথায় সম্মত হয়। সাজাহ্- মালেক ছাড়া বনু তামীমের অন্যান্য নেতাদেরও একজোট হবার প্রস্তাব দেয়, কিন্তু ‘ওয়াকী’ ছাড়া আর কেউ তার ডাকে সাড়া দেয় নি। তখন সাজাহ্, মালেক ও ওয়াকী’কে সাথে নিয়ে অন্যান্য নেতার বিরুদ্ধে লড়াই আরম্ভ করে। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় এবং উভয় পক্ষের অনেক মানুষ নিহত হয় এবং স্বগোত্রীয়রা একে অপরকে বন্দি করে। কিন্তু কিছুকাল পরেই মালেক ও ওয়াকী বুঝতে পারে- এই নারীর কথা শুনে তারা চরম ভুল করেছে; তাই তারা অন্য নেতাদের সাথে সন্ধি করে নেয়। সাজাহ্ যখন দেখল এখানে তার স্বার্থোদ্ধার হবে না, তখন সে নিজ বাহিনী নিয়ে মদীনাভিমুখে যাত্রা করে। পথিমধ্যে নিবাজ পৌঁছলে অওস বিন খুযায়মা’র সাথে তার লড়াই হয় এবং সাজাহ্ পরাজিত হয়; অওস তাকে এই শর্তে ছেড়ে দেন যে, সে ভুলেও মদীনার দিকে পা বাড়াবে না। এরূপ পরিস্থিতিতে তার সাথে থাকা সেনাদলের নেতারা তাকে জিজ্ঞেস করে- এখন করণীয় কী? সাজাহ্ তাদেরকে ছন্দবদ্ধ পঙক্তি আবৃত্তি করে ইয়ামামা অভিমুখে যেতে বলে; তারা যদিও ইয়ামামাবাসীদের সাথে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক ছিল না, কিন্তু সাজাহ্র ছন্দময় পঙক্তিকে ওহী মনে করায় তারা সেদিকে অগ্রসর হতে বাধ্য হয়। ওদিকে মুসায়লামা কায্যাব চিন্তায় পড়ে যায় যে, এদের সাথে লড়তে গেলে তার শক্তি-প্রতিপত্তি কমে যাবে। তাই সে তাদের সাথে সন্ধি করার চেষ্টা করে এবং গোপনে সাজাহ্র সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় এবং সাজাহ্ তা গ্রহণ করে। বিয়ের পর সাজাহ্ নিজ দেশ জাযিরায় ফিরে যায়। কতকের মতে সে পরে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, আবার কতেকের মতে সে হযরত উমর (রা.)’র যুগে ইসলাম গ্রহণ করে; আমীর মুয়াবিয়ার যুগে সে বনু তামীমে ফিরে যায় ও মুসলমান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।
হযরত আবু বকর (রা.) হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ (রা.)-কে তুলায়হাকে দমন করার পর বুতাহ্ গিয়ে মালেক বিন নুওয়াইরার খোঁজ নিতে বলেছিলেন। হযরত খালিদ (রা.) বুতাহ্ গিয়ে দেখেন সেখানে কেউ নেই। তিনি তখন আশপাশের অঞ্চলে ছোট ছোট দল পাঠান ও সেখানকার বাসিন্দাদের ইসলামের প্রতি আহ্বান জানাতে বলেন; যারা ইসলাম গ্রহণ করবে না তাদের গ্রেফতার করে আনতে আর যারা যুদ্ধে করবে তাদের হত্যা করতে নির্দেশ দেন। এই দলগুলোর একটি মালেক এবং তার কয়েকজন সাথী আসেম, উবায়েদ, জাফরকে বন্দি করে হযরত খালিদ (রা.)’র কাছে নিয়ে আসে। উক্ত দলে হযরত আবু কাতাদা (রা.)ও ছিলেন, কিন্তু দলের অন্যদের সাথে তার মতানৈক্য হয়। দলের কতকের মতে যখন তারা আযান দেন ও নামায পড়েন তখন মালেক এবং তার সাথীরাও তাদের সাথে নামায পড়েছিল, অন্যদের মতে তারা তা করে নি। শেষোক্ত পক্ষের বক্তব্য শুনে হযরত খালিদ (রা.) তাদের বন্দি করেন।
মালেক বিন নুওয়াইরাকে হত্যা করা সম্পর্কে দু’টি বর্ণনা রয়েছে। এক বর্ণনামতে সেদিন রাতে প্রচণ্ড শীত পড়েছিল, তাই হযরত খালিদ (রা.)’র নির্দেশে একজন ঘোষক ঘোষণা করে- ‘আদফিউ আসরাকুম’ অর্থাৎ বন্দিদের শীত থেকে রক্ষা ব্যবস্থা কর, কিন্তু বনু কিনানা গোত্রের বাগধারায় একথার অর্থ ছিল, বন্দিদের হত্যা কর; এই ভুল বোঝাবুঝির ফলে সৈন্যরা সকল বন্দিকে হত্যা করে। মালেক বিন নুওয়াইরাকে হত্যা করেন যিরার বিন আযওয়ার। অপর বর্ণনামতে হযরত খালিদ (রা.), মালেককে ডেকে তাকে সাজাহ্’র সাথে জোট বাঁধা ও যাকাত বিষয়ে উল্টোপাল্টা করায় শাসিয়ে বলেন, ‘তুমি কি জান না- নামায ও যাকাত সমান গুরুত্ববহ?’ মালেক তখন ধৃষ্টতা দেখিয়ে বলে, ‘তোমাদের সাথী এমনটি মনে করতো!’ রসূলুল্লাহ্ (সা.) না বলে ‘সাহিবুকুম’ বলায় হযরত খালিদ (রা.) রুষ্ট হয়ে তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। ইতিহাস বলে, এই বিষয়টি নিয়ে আবু কাতাদার সাথে হযরত খালিদ (রা.)’র বিতণ্ডা হয়। আবু কাতাদা বাহিনী ছেড়ে হযরত আবু বকর (রা.)’র কাছে যান ও অভিযোগ করেন, ‘মালেক মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও খালিদ তাকে হত্যা করেছেন এবং তার স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন’। হযরত উমর (রা.) আবু কাতাদার সাথে একমত হয়ে হযরত আবু বকর (রা.)-কে খালিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন। আবু বকর (রা.) প্রথমতঃ আমীরের অনুমতি না নিয়ে আবু কাতাদার মদীনা আসায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে তাকে খালিদের কাছে ফিরে যেতে বলেন। তিনি বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যাচাই করে জানতে পারেন, এটি হযরত খালিদ (রা.)’র ভুল বুঝার ফলে ঘটেছে; তাই তিনি মালেকের রক্তপণ আদায় করে দেন ও হযরত উমর (রা.)-কে এ বিষয়ে কথা বলতে বারণ করেন। তাবারীর মতে, হযরত আবু বকর (রা.), খালিদকে মদীনায় ডেকে পাঠান এবং খালিদ পুরো ঘটনা বর্ণনা করে ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন এবং আবু বকর (রা.) তাকে ক্ষমা করে দেন।
বিষয়টি যেহেতু অত্যন্ত নাজুক এবং এটি নিয়ে সাহাবীদের বিরুদ্ধে আপত্তি ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই হুযূর বিষয়টি সবিস্তারে আলোকপাত করেন; আল্লামা ইবনে কাসীর, আল্লামা ইবনে খাল্লিকান, শাহ্ আব্দুল আযীয দেহলভী, আল্লামা মাওয়ারদী এবং ড. আলী মুহাম্মদ সালাবীসহ বিভিন্ন ইতিহাসবিদ ও গবেষকের বিশ্লেষণ তুলে ধরে তিনি বিষয়টি সুস্পষ্ট করেন। মালেক যদিও বাইরে প্রকাশ করছিল যে, সে মুসলমান, কিন্তু তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর তার উল্লাস, তার পরিবারের আনন্দোৎসব উদযাপন প্রভৃতি বিষয় থেকে তার প্রকৃত মনোভাব আগেই প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিল যে, সে আসলে কাফির ও বিদ্রোহী। তার স্ত্রী লায়লা বিনতে মিনহালকে ইদ্দত পূর্ণ হবার পূর্বেই বিয়ে করার ব্যাপারে যে মিথ্যা আপত্তি হযরত খালিদ (রা.)’র বিরুদ্ধে করা হয়, বিভিন্ন সূত্রে হুযূর (আই.) এরও অপনোদন করেন। ইসলামী শরীয়ত ও মহানবী (সা.)-এর আদর্শের বাইরে হযরত খালিদ (রা.) কোন কাজ করেন নি; উপরন্তু এ-ও জানা যায়, মালেক তার স্ত্রী লায়লাকে অনেক আগেই তালাক দিয়ে বাড়িতে আটকে রেখেছিল। মোটকথা, হযরত খালিদ (রা.)’র বিরুদ্ধে এসব অপবাদ ছিল নির্জলা মিথ্যা; হযরত খালিদ (রা.)’র বিরোধিরা এগুলোকে পুঁজি করে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটিয়েছিল, কিন্তু হযরত আবু বকর (রা.) তাকে এসব অপবাদ থেকে দায়মুক্ত করেন।
হযরত খালিদ (রা.)’র ইয়ামামা অভিযানের বিষয়েও হুযূর (আই.) আলোচনা আরম্ভ করেন এবং এ বিষয়ে তাকে হযরত আবু বকর (রা.) পত্র মারফৎ যেসব নির্দেশনা ও উপদেশ দিয়েছিলেন তা তুলে ধরেন। হযরত আবু বকর (রা.) তার সুরক্ষার জন্য পেছনে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বড় একটি সৈন্যদলও প্রেরণ করেছিলেন। পথিমধ্যে হযরত খালিদ (রা.) অনেক মুরতাদ বেদুঈন গোত্রকে যুদ্ধ করে ইসলামে ফিরিয়ে আনেন, সাজাহ্র বাহিনীর রয়ে যাওয়া শত্রুদের শায়েস্তা করেন এবং অবশেষে ইয়ামামা আক্রমণ করেন। হুযূর (আই.) বলেন, ইয়ামামার যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ আগামী খুতবায় বর্ণনা করা হবে, ইনশাআল্লাহ্।