আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌, আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২০শে মে, ২০২২ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় সাম্প্রতিক ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় হযরত আবু বকর (রা.)’র ধারাবাহিক স্মৃতিচারণের ধারা অব্যাহত রাখেন রাখেন এবং হযরত খালিদ (রা.)’র নেতৃত্বে পরিচালিত ইয়ামামার যুদ্ধাভিযান সম্পর্কে আলোচনা করেন।
তাশাহ্হুদ, তা’ঊয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)’র যুগে সংঘটিত ইয়ামামার যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল। ইয়ামামা ছিল ইয়েমেনের একটি প্রসিদ্ধ শহর, এটি বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থিত। এটি অত্যন্ত সবুজ-শ্যামল ও সমৃদ্ধ একটি শহর ছিল যেখানে বনু হানীফা গোত্র বাস করতো, এরা প্রচণ্ড যুদ্ধবাজ জাতি ছিল। তফসীরে কুরতুবীতে সূরা ফাতাহ্’র ১৭নং আয়াতে উল্লিখিত ‘প্রচণ্ড যুদ্ধবাজ জাতি’ সম্পর্কে প্রথম যুগের প্রসিদ্ধ আলেমদের বিভিন্ন অভিমত লিপিবদ্ধ রয়েছে; যুহরী, মুকাতিল ও রাফে বিন খাদিজের মতে তারা হল, বনু হানীফা গোত্র। মহানবী (সা.) ৬ষ্ঠ বা ৭ম হিজরীতে যখন বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ্‌র নামে তবলীগি পত্র প্রেরণ করেন, তখন ইয়ামামার রাজা হাওযা বিন আলী ও ইয়ামামাবাসীর প্রতিও ইসলামগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে পত্র পাঠিয়েছিলেন। ৯ম হিজরীতে যখন মদীনায় বিভিন্ন গোত্র থেকে প্রতিনিধিদল আসে তখন ইয়ামামা থেকে বনু হানীফা গোত্রের প্রতিনিধিদলও আসে; তাতে রাজ্জাল বিন উনফাওয়া, মুজাআ’ বিন মুরারা, মুসায়লামা কাযযাব, সামামা বিন কবীর প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ছিল। মুসায়লামার আসল নাম ছিল মুসায়লামা বিন সামামা এবং ডাকনাম ছিল আবু সামামা। বনু হানীফা গোত্র যখন মহানবী (সা.)-এর সকাশে উপস্থিত হয় তখন মুসায়লামাকে সাথে আনে নি, বরং তাকে কাফেলার জিনিসপত্র দেখাশোনার জন্য রেখে এসেছিল; ইসলাম গ্রহণের পর তারা মহানবী (সা.)-কে তার কথা অবগত করলে তিনি (সা.) বনু হানীফা গোত্রের নতুন মুসলমানদের মত তার জন্যও উপহার ইত্যাদি দিয়ে দেন এবং বলেন, তার মর্যাদা তোমাদের চেয়ে কম নয়, কারণ সে তোমাদের হয়ে জিনিসপত্র পাহারা দিচ্ছে। অবশ্য এমন কিছু রেওয়ায়েতও আছে যাতে মুসায়লামার বনু হানীফা গোত্রের লোকজনসহ মহানবী (সা.)-এর সাথে সাক্ষাতের বর্ণনা রয়েছে। বুখারী শরীফে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)’র বরাতে বর্ণিত হয়েছে, মুসায়লামা মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে দাবী জানায়, তিনি (সা.) যদি তাঁর তিরোধাণের পর তাকে নবী ও নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নির্বাচন করে যান, তবে সে তাঁকে (সা.) মান্য করবে। মহানবী (সা.) তখন নিজের হাতে থাকা খেজুরের লাঠিটি দেখিয়ে বলেন, আল্লাহ্‌র অনুমতি ছাড়া তিনি তাকে সেই লাঠিটি দিতেও প্রস্তুত নন। তিনি (সা.) এ-ও বলেন, তাঁকে যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছে- তা মুসায়লামার প্রতিই ইঙ্গিত করে বলে তিনি মনে করছেন। তিনি (সা.) এরপর তাঁর সাথে থাকা হযরত সাবেত বিন কায়েস (রা.)-কে তার কথার জবাব দেয়ার নির্দেশ দিয়ে চলে আসেন। মহানবী (সা.) স্বপ্নে দেখেছিলেন, তাঁর হাতে দু’টি সোনার কঙ্কণ রয়েছে; তিনি তা দেখে অপছন্দ করলে স্বপ্নেই তাঁর প্রতি ওহী করা হয়, তিনি যেন সেগুলোতে ফুঁ দেন। যখন তিনি ফুঁ দেন তখন সেগুলো উড়ে যায়। মহানবী (সা.) ব্যাখ্যা করেন, এর অর্থ হল তাঁর পরে দু’জন ভণ্ড নবীর আবির্ভাব হবে, বর্ণনাকারীর মতে একজন হল; মুসায়লামা ও অন্যজন আসওয়াদ আনসী।
এরূপ বিভিন্ন রেওয়ায়েত থেকে সাব্যস্ত হয়, মুসায়লামা কমপক্ষে দু’বার মদীনায় এসেছিল; প্রথমবার তার মহানবী (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ হয় নি, পরেরবার তার দেখা হয় এবং সে মহানবী (সা.)-এর কাছে স্থলাভিষিক্ত হবার অভিপ্রায় প্রকাশ করে। যাহোক, মুসায়লামা ইয়ামামা ফিরে গিয়ে নবুয়্যতের মিথ্যা দাবী করে বসে এবং বলে, তাকেও মহানবী (সা.)-এর সাথে নবুয়্যতে অংশীদার করা হয়েছে। সে মনগড়া পঙক্তি রচনা করে সেগুলো ওহী বলে দাবী করে এবং নিজের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টির লক্ষ্যে শরীয়ত বদলে দেয়। অর্থাৎ, ফজর ও এশার নামায মাফ করে দেয়, মদ ও ব্যভিচারের অনুমোদন প্রভৃতি দিয়ে শরীয়তের মাঝে বিকৃতি সৃষ্টি করে। এই ধূর্ত ব্যক্তি এ-ও স্বীকার করতো যে, মহানবী (সা.) সত্য নবী, কারণ সে জানতো- যদি সে সরাসরি মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে বলে তবে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না; তাই সে মহানবী (সা.)-এর আনুগত্যেরও দাবী করতো, অন্যদিকে এসব উল্টোপাল্টা কথাও বলতো। অর্থাৎ, সে খুব ধূর্ত এবং মুনাফিক ছিল। এই প্রতারণায় তার সফল হবার পেছনে রাজ্জাল বিন উনফাওয়াও বড় ভূমিকা রেখেছিল। রাজ্জাল মদীনা গিয়ে কুরআন ও ইসলাম শিখেছিল; মুসায়লামা এসব অপপ্রচার শুরু করলে মহানবী (সা.) তাকে মুয়াল্লিম হিসেবে ইয়ামামা প্রেরণ এসব মিথ্যাচারের অপনোদন করতে। সে উল্টো মুসায়লামার ক্রমবর্ধমান প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখে তার পক্ষ অবলম্বন করে আর বলে, মহানবী (সা.)-ই বলেছেন- মুসায়লামাকে তাঁর নবুয়্যতে অংশীদার করা হয়েছে। ইয়ামামার জনসাধারণ যখন দেখে যে, মদীনায় প্রশিক্ষিত, কুরআন প্রচারকারী একজন ব্যক্তি এসব বলছে- তখন তারা স্বভাবতই তা সত্য ভেবে দলে দলে মুসায়লামার হাতে বয়আ’ত করতে শুরু করে। মুসায়লামা, মহানবী (সা.)-এর কাছে নিজের মিথ্যা দাবী সম্বলিত পত্রও প্রেরণ করেছিল যার খণ্ডন করে মহানবী (সা.) পত্র পাঠান। মুসায়লামা মহানবী (সা.)-এর পত্রবাহক হযরত হাবীব বিন যায়েদ (রা.)-কে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে, এছাড়া মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে নির্ধারিত তত্ত্বাবধায়ক হযরত সুমামা বিন আসাল (রা.)-কেও ইয়ামামা থেকে বিতাড়িত করে।
তার অপকর্ম ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে হযরত আবু বকর (রা.) তার বিরুদ্ধে হযরত ইকরামা (রা.)-র নেতৃত্বে একটি সৈন্যদল পাঠান ও তার সাহায্যার্থে হযরত শুরাহবিল বিন হাসানা (রা.)-র নেতৃত্বেও একটি সেনাদল পাঠান এবং নির্দেশ দেন, হযরত শুরাহবিল (রা.) না আসা পর্যন্ত ইকরামা যেন যুদ্ধ আরম্ভ না করেন। কিন্তু হযরত ইকরামা (রা.) আক্রমণ করতে তাড়াহুড়ো করেন এবং যুদ্ধে পরাজিত হন। হযরত আবু বকর (রা.) যখন একথা জানতে পারেন তখন অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন এবং তাঁর স্পষ্ট নির্দেশ লঙ্ঘন করায় হযরত ইকরামা (রা.)-কে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করে মদীনা আসতে নিষেধ করেন, কারণ তাদের দেখে অন্য মুসলমানরা হতোদ্যম হতে পারেন। তিনি তাকে হযরত হুযায়ফা (রা.) ও হযরত আরফাজার (রা.) কাছে গিয়ে তাদের সাথে একত্রে ওমান ও মাহরাবাসীদের সাথে যুদ্ধ করতে নির্দেশ দেন। হযরত আবু বকর (রা.) হযরত শুরাহবিল (রা.)-কে হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ (রা.)-এর আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন, কিন্তু তিনিও খলীফার নির্দেশ অমান্য করে আগেই আক্রমণ করে বসেন ও পরাজিত হন; হযরত খালিদ (রা.) এতে চরম অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।
হযরত আবু বকর (রা.) হযরত খালিদ (রা.)-কে ইয়ামামা অভিমুখে প্রেরণ করেন এবং তার অধীনে মুহাজির ও আনসারদের বড় একটি সৈন্যদল ছিল; আনসার ও মুহাজিরদের নেতা ছিলেন যথাক্রমে সাবেত বিন কায়স এবং হযরত আবু হুযায়ফা (রা.) ও হযরত যায়েদ বিন খিতাব (রা.)। এছাড়া তাদের সাহায্যের জন্য হযরত সালীত (রা.)-র নেতৃত্বে আরও একটি দল পাঠান। হযরত খালিদ (রা.) পুরো বাহিনী একত্র হবার পর ইয়ামামা অভিমুখে অগ্রসর হন। বনু হানীফা গোত্রের বাহিনীতে চল্লিশ হাজার মতান্তরে এক লক্ষাধিক প্রশিক্ষিত সৈন্য ছিল আর মুসলমান বাহিনীতে ছিল মাত্র দশ হাজারের কিছু বেশি যোদ্ধা। ইয়ামামা যাবার পথে বনু হানীফা গোত্রের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা মুজাআ’ বিন মুরারা মুসলিম বাহিনীর হাতে আটক হয়। হযরত খালিদ (রা.) ইসলামের বিরুদ্ধাচরণের জন্য তার বাকি সঙ্গীদের হত্যা করলেও তাকে ও সারিয়া বিন মুসায়লামা নামক আরেকজনকে জীবিত রাখেন। মুজাআ’ বারবার বলছিল সে মুসলমান; অবশ্য পরে বুঝা যায়, সে মিথ্যা বলেছিল। এসব ঘটনা ঘটে আরিয-এ। এরপর হযরত খালিদ (রা.) ইয়ামামা অভিমুখে অগ্রসর হন। ওদিকে মুসায়লামা নিজ বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়ে আকরাবায় শিবির স্থাপন করে। হযরত খালিদ (রা.) ভালোভাবে নিজ বাহিনীকে সুবিন্যস্ত করেন, কারণ তিনি কখনও শত্রুকে দুর্বল মনে করতেন না। তার সম্পর্কে জানা যায়, যুদ্ধের পূর্বে তিনি সৈন্যদের ঘুমানোর সুযোগ দিলেও নিজে ঘুমাতেন না, বরং নিঁখুতভাবে যুদ্ধের পরিকল্পনা করতেন যেন কোন ফাঁক না থেকে যায়। অগ্রগামী বাহিনীর নেতৃত্বভার দেন হযরত শুরাহবিল (রা.)-কে এবং মূল বাহিনী ৫ভাগে বিভক্ত করে বিভিন্ন অংশের নেতৃত্বভার প্রদান করেন হযরত খালিদ মাখযূমী (রা.), হযরত আবু হুযায়ফা (রা.), হযরত শুজাআ’ (রা.), হযরত উসামা বিন যায়েদ (রা.) প্রমুখদের। অতঃপর উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়; মুসলমানরা পূর্বে কখনও এত কঠিন যুদ্ধের সম্মুখীন হন নি, সাময়িকভাবে তাদের পিছুও হটতে হয়। বনু হানীফা গোত্রের লোকেরা মুজাআ’কে মুক্ত করে নেয় এবং সে তাদেরকে মুসলমান পুরুষদের ওপর আক্রমণ করতে বলে; এটি প্রমাণ করে তার মুসলমান হবার দাবি মিথ্যা ছিল। মুসলিম বাহিনী পিছু হটলেও হযরত খালিদ (রা.)-এর দৃঢ়তা ও উদ্যমে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়ে নি; তিনি ঘোষণা দেন, মুসলমানরা যেন নিজ নিজ গোত্র অনুসারে নতুনভাবে দলবদ্ধ হয়ে শত্রুর সাথে লড়াই করে এবং স্ব-স্ব গোত্রের বীরত্ব প্রদর্শন করে। ফলে মুসলমানরা নতুন উদ্যম-উৎসাহে লড়াই শুরু করেন, একে অপরকে অনুপ্রাণিত করেন। হযরত সাবেত বিন কায়স (রা.)-এর নাম এখানে উল্লেখ্য যিনি প্রবল উদ্যমে লড়াই করতে করতে শাহাদত বরণ করেন। হুযূর (আই.) বলেন, এই বর্ণনা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে, ইনশাআল্লাহ্।
খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) সম্প্রতি প্রয়াত কয়েকজন নিষ্ঠাবান আহমদীর গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন এবং তাদের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন। তন্মধ্যে প্রথম হলেন, মাস্টার মুনাওয়ার আহমদ সাহেবের পুত্র মোকাররম শহীদ আব্দুস সালাম সাহেব, যাকে গত ১৭ই মে, ২০২২ তারিখে তার নাবালক দুই শিশুপুত্রের চোখের সামনে ছুরিকাঘাতে শহীদ করা হয়; হত্যাকারী হল সদ্য হিফয পাস করা এক উগ্রবাদী মৌলভী, যে তার শিক্ষকদের উস্কানিতে এই অপকর্ম করে। শহীদ মরহুম অসাধারণ বিভিন্ন গুণের অধিকারী ছিলেন; হুযূর (আই.) তার জান্নাতুল ফেরদৌসে উচ্চ মাকাম লাভের এবং তার স্ত্রী-সন্তান, পিতা-মাতাসহ পরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া করেন। এছাড়া হুযূর (আই.) শেখ সাঈদুল্লাহ্ সাহেবের পুত্র ও সাহাবী হযরত শেখ রহমতুল্লাহ্ সাহেবের প্রপৌত্র মোকাররম যুলফিকার আহমদ সাহেব ও ২০১০-এ লাহোরের মসজিদে শহীদ মালেক মাকসুদ আহমদ সাহেবের পুত্র মালেক তাবাসসুম মাকসুদ সাহেবেরও স্মৃতিচারণ করেন ও তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করেন।

Leave a Reply