আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌, আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৯শে জুলাই, ২০২২ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় সাম্প্রতিক ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় হযরত আবু বকর (রা.)’র ধারাবাহিক স্মৃতিচারণের ধারা অব্যাহত রাখেন রাখেন এবং তাঁর খিলাফতকালে ইরানীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত তাঁর যুদ্ধাভিযান সম্পর্কে আলোচনা করেন। খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) আগত সালানা জলসা যুক্তরাজ্য ২০২২’র উল্লেখ করে জলসার সার্বিক সফলতা এবং অংশগ্রহণকারী ও স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য দোয়ার আহ্বান জানান।
তাশাহ্হুদ, তা’ঊয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)’র যুগের বিভিন্ন যুদ্ধাভিযানের বর্ণনা চলছিল। হুযূর খালেদ বিন ওয়ালীদ (রা.)’র নেতৃত্বে পরিচালিত এসব যুদ্ধাভিযানের অবশিষ্টাংশ এই খুতবায় তুলে ধরেন। দ্বাদশ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে হীরার যুদ্ধ সংঘটিত হয়; হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ (রা.) আমগেশিয়া থেকে হীরা অভিমুখে অগ্রসর হন যা ফোরাত নদীর তীরে আরব খ্রিস্টানদের একটি প্রাচীন কেন্দ্র ছিল। হীরার শাসক ছিল একজন ইরানী বংশোদ্ভূত। সে আঁচ করতে পেরেছিল যে, হযরত খালেদ নিশ্চয় এবার এদিকেই অগ্রসর হবেন, এজন্য সে যুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। সে জানত, খালেদ (রা.) নদীপথেই সেখানে আসবেন, তাই সে তার ছেলেকে ফোরাত নদীর পানি আটকে রাখার দায়িত্ব দেয় যেন হযরত খালেদের নৌবহর কাদায় আটকে যায় আর তিনি এখানে আসতে না পারেন। আর তার সৈন্যদলও হীরার বাইরে এসে অবস্থান নেয়। হযরত খালেদের নৌবহর কাদায় আটকে গেলে মাঝিরা তাকে বলে, ইরানীরা নদীর পানি খালের মধ্য দিয়ে অন্যদিকে প্রবাহিত করছে; এটি না থামালে নদীতে পানি আসবে না আর আমরাও এগোতে পারবো না। তখন হযরত খালেদ (রা.) একদল অশ্বারোহী নিয়ে হীরার শাসকের ছেলের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন। পথিমধ্যে শত্রুবাহিনীর একটি দলের সাথে তাদের যুদ্ধ হয় এবং তারা শত্রুদের ওপর আকস্মিক আক্রমণ করে তাদের সবাইকে হত্যা করেন। কিছুদূর এগিয়ে খালেদ দেখেন, হীরার শাসকের ছেলে নদীর পানি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করছে। তিনি আক্রমণ করে তাদেরকেও নিশ্চিহ্ন করেন এবং বাঁধ ভেঙে নদীর পানি পুনরায় প্রবাহিত করার ব্যবস্থা করেন। হীরার শাসক যখন জানতে পারে যে, তার ছেলে নিহত হয়েছে এবং সম্রাট আর্দশীরও মারা গিয়েছে, তখন সে রণে ভঙ্গ দিয়ে নৌকায় চড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু হীরার অধিবাসীরা তবুও মনোবল হারায় নি; তারা তাদের চারটি দুর্গে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। খালেদ (রা.) যিরার বিন আযওয়ার, যিরার বিন খাত্তাব, যিরার বিন মুকাররিন ও মুসান্না বিন হারসাকে একেকটি দুর্গ অবরোধ করার দায়িত্ব দেন; তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তারা যেন শত্রুদের প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করার আহ্বান জানান। কিন্তু শত্রুরা তাতে সাড়া না দিলে যুদ্ধ শুরু হয় এবং শত্রুরা পরাজয় আসন্ন দেখে আত্মসমর্পণ করে। হযরত খালেদ (রা.) আশা করেছিলেন, তারা যেহেতু আরব বংশোদ্ভূত তাই তারা ইসলাম গ্রহণ করবে; কিন্তু তিনি আশ্চর্য হয়ে দেখেন তারা জিযিয়া বা কর প্রদানে সম্মত হলেও খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করতে রাজি নয়। তাই তাদের জন্য বার্ষিক ১ লক্ষ ৯০ হাজার দিরহাম জিযিয়া বা কর ধার্য করা হয়। তাদের সাথে চুক্তিপত্র করা হয় এবং তাতে উল্লেখ করা হয়, যদি তারা কথায় বা কাজে কোনরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে এই চুক্তিপত্র বাতিল বলে গণ্য হবে। হযরত আবু বকর (রা.)’র মৃত্যুর পর হীরার লোকেরা চুক্তিভঙ্গ করেছিল। তখন হযরত মুসান্না (রা.)পুনরায় তাদের পরাজিত করেন এবং নতুন চুক্তিপত্র সম্পাদিত হয়, কিন্তু তারা আবারও তা ভঙ্গ করে এবং পরবর্তীতে হযরত সা’দ (রা.) পুনরায় হীরা জয় করেন। হীরা জয়ের মাধ্যমে ইরাকে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা সুসংহত হয়ে গেলে হযরত খালেদ (রা.) সরাসরি ইরান আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ওদিকে সম্রাট আর্দশীরের মৃত্যুর পর সিংহাসন নিয়ে ইরানে অভিজাত শ্রেণীর মাঝে টানাপোড়েন শুরু হয়। খালেদ (রা.) তাদেরকে পত্র পাঠিয়ে ইসলামগ্রহণের আহ্বান জানান, নতুবা জিযিয়া বা কর দিয়ে বশ্যতা স্বীকার করতে অথবা তার সাথে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হতে বলেন।
দ্বাদশ হিজরীতে আম্বার বা যাতুল-উয়ূন এর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইরানী বাহিনী হীরার একদম সন্নিকটে আম্বার ও আঈনুত্ তামার নামক স্থানদ্বয়ে অবস্থান নিয়েছিল। আম্বার বালাখের নিকটবর্তী একটি শহর; খাদ্যশস্যের প্রাচুর্যের জন্য এর এরূপ নামকরণ হয়েছিল, কারণ আরবীতে শস্যভাণ্ডারকে আম্বার বলে। আঈনুত্ তামারও আম্বারের নিকটবর্তী একটি শহর। হযরত খালেদ (রা.) এত নিকটে চলে আসা শত্রুদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, অন্যথায় প্রথমে শত্রুর আক্রমণ হওয়ার সমূহ শংকা ছিল। হযরত খালেদ (রা.) হীরায় হযরত কা’কা বিন আমরকে নিজের স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করে স্বয়ং হযরত আইয়ায বিন গানামকে সাহায্য করতে আম্বার অভিমুখে অগ্রসর হন। আইয়ায, হযরত আবু বকর (রা.)’র নির্দেশে উত্তর দিক থেকে ইরাক-জয়ের জন্য এগিয়েছিলেন এবং তিনি আম্বার অবরোধ করে রাখেন। আম্বারে শত্রুদের নেতৃত্বে ছিল শিরাযায; তারা দুর্গের বাইরে পরিখা খনন করে তাতে পানি ভরে দুর্গের ভেতরে অবস্থান নিয়েছিল। পরিখা বেশি প্রশস্ত ছিল না, তাই মুসলিম বাহিনী কাছাকাছি গেলেই শত্রুরা দুর্গের দেয়ালের ওপর থেকে তির ছুঁড়ে মুসলমানদের পিছু হটতে বাধ্য করছিল। এমতাবস্থায় হযরত খালেদ (রা.) সেখানে পৌঁছেন। তিনি সবকিছু যাচাই করে এক হাজার দক্ষ তিরন্দাজকে শত্রুদের চোখ লক্ষ্য করে একাধারে তির নিক্ষেপের নির্দেশ দেন। এতে সেদিন শত্রুসেনাদের প্রায় এক হাজার সৈন্য দৃষ্টিশক্তি হারায়; এজন্যই এই যুদ্ধের নাম যাতুল-উয়ূন বা চোখের যুদ্ধ হয়েছিল। শত্রুরা বিচলিত হয়ে পড়ে, কিন্তু শিরাযায তবুও আত্মসমর্পণ না করার গোঁ ধরে থাকে। ইতোমধ্যে খালেদ (রা.) পরিখার এক প্রান্ত মৃত উট দিয়ে ভরাট করে দুর্গে আক্রমণের উপক্রম করলে শিরাযায প্রস্তাব দেয়, তাকে কিছু সঙ্গীসহ দুর্গত্যাগের সুযোগ দেয়া হলে দুর্গে অবস্থানরত সেনারা অস্ত্র সমর্পণ করবে; খালেদ (রা.) এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এই ঘটনা খালেদ (রা.)’র মহত্বের পরিচায়ক; চরম শত্রুকে হাতে পেয়েও তিনি ছেড়ে দিয়েছেন, উপরন্তু সে দাবি না করলেও খালেদ (রা.) তাকে তিনদিনের রসদও দিয়ে দেন। আম্বার জয়ের পর আশপাশের অন্যান্য গোত্রের সাথেও মুসলমানদের সন্ধিচুক্তি হয়।
আম্বার থেকে তিনদিনের দূরত্বে অবস্থিত ছিল আঈনুত্ তামার, দ্বাদশ হিজরীতে এটিও জয় করা হয়। ইরানের পক্ষ থেকে সেখানে মেহরান শাসক হিসেবে নিযুক্ত ছিল। ইরানী বাহিনী ছাড়াও সেখানে বেদুঈন আরবদের বড় একটি দল ছিল যাদের নেতা ছিল আক্কাহ্ বিন আবি আক্কাহ্। মেহরান, আক্কাহ্কে কৌশলে হযরত খালেদের সাথে যুদ্ধের জন্য ঠেলে দেয় এবং নিজে বাহিনী নিয়ে আঈনুত্ তামারেই অবস্থান করে। আক্কাহ্র বাহিনীকে খালেদ (রা.) হঠাৎ আক্রমণ করেন, আক্কাহ্ বন্দি হয় এবং তার বাহিনী পালিয়ে যায়। এ খবর শুনে মেহরান দুর্গ ছেড়ে সদলবলে পালিয়ে যায়। আক্কাহ্র পলাতক বাহিনী এসে দুর্গে অবস্থান নেয়, কিন্তু হযরত খালেদ (রা.) দুর্গ অবরোধ করলে এক পর্যায়ে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এভাবে আঈনুত্ তামার মুসলমানরা জয় করেন।
এরপর দুমাতুল জান্দালের যুদ্ধও দ্বাদশ হিজরীতে সংঘটিত হয়; এটি দামেস্ক থেকে পাঁচ দিনের দূরত্বে অবস্থিত ছিল। হযরত আবু বকর (রা.) আইয়ায বিন গানামকে সেখানে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু আইয়ায দীর্ঘ দিন চেষ্টা করেও তা জয় করতে পারেন নি। অতঃপর তিনি খালেদ (রা.)-কে সাহায্যের জন্য আহ্বান জানালে তিনি দ্রুত সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। দুমার সেনাবাহিনী দু’টি বড় দলে বিভক্ত ছিল, তাদের নেতৃত্বে ছিল জুদি বিন রবীআ ও উকায়দার। খালেদের আগমনের সংবাদ শুনে তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়; উকায়দার খালেদের বিরুদ্ধে লড়াই না করে সন্ধি করতে বলে, কিন্তু জুদি তাতে সম্মত হয় নি। উকায়দার রণে ভঙ্গ দিয়ে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু হযরত খালেদ (রা.) সংবাদ পেয়ে তাকে আটক করান এবং ইতোপূর্বে মহানবী (সা.)-এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তিস্বরূপ উকায়দারকে হত্যা করেন। এমন বর্ণনাও পাওয়া যায় যে, তাকে মদীনায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর খালেদ এবং আইয়ায দুমা জয় করেন, এই জয় রণকৌশলগত দিক থেকে মুসলমানদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এরপর হযরত খালেদ (রা.) হুসায়েদ ও খানাফিস জয় করেন। খালেদ (রা.) দুমা থাকাকালেই বাগদাদ থেকে যারমেহর ও রূযবা নামক দুই সেনাপতি তাদের সেনাবহর নিয়ে আম্বার অভিমুখে অগ্রসর হয় এবং তারা খানাফিস ও হুসায়েদে অবস্থান নেয়। খালেদ (রা.) হীরা গিয়ে একথা জানতে পেরে কা’কা বিন আমর ও আবু লায়লাকে যথাক্রমে হুসায়েদ ও খানাফিস অভিমুখে প্রেরণ করেন, তিনি নিজেও পরে সেদিকে অগ্রসর হন। কা’কা হুসায়েদ আক্রমণ করলে রূযবাকে সাহায্য করার জন্য যারমেহরও সেখানে আসে, কিন্তু তারা যুদ্ধে পরাজিত হয়; কা’কা যারমেহরকে হত্যা করেন, রূযবাও নিহত হয়। শত্রুরা খানাফিস থেকে ভয়ে পালিয়ে যায় আর আবু লায়লা নির্বিঘ্নে তা জয় করেন। এরপর পলাতক শত্রুসেনারা মুসাইয়াখ গিয়ে জড়ো হয়; হযরত খালেদ (রা.) তা জানতে পেরে আবু লায়লা, কা’কা’ প্রমুখের সাথে একযোগে শত্রুর ওপর ত্রিমুখী আক্রমণের পরিকল্পনা করেন; এরূপ আক্রমণে শত্রুরা দিশেহারা হয়ে পরাজিত হয়, তাদের নেতা হুযায়েল পালিয়ে যায় এবং মুসাইয়াখ বিজিত হয়।
আঈনুত্ তামারের যুদ্ধে নিহত আরব নেতা আক্কাহ্ হত্যার প্রতিশোধ নিতে রবীআ বিন বুজায়ের তার বাহিনী নিয়ে সান্নী ও যুমায়েল তথা বিশর নামক স্থানে আসে; মুসাইয়াখের মত হযরত খালেদ (রা.)ও সান্নীতে অতর্কিতে ত্রিমুখী আক্রমণ করে তাদের পরাজিত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিশর ও রুযাব নামক আরেকটি স্থানও তিনি জয় করেন। রুযাব থেকে খালেদ (রা.) ফিরায অভিমুখে অগ্রসর হন, পথিমধ্যে তাকে অনেকগুলো যুদ্ধ করতে হয়। বসরা ও ইয়ামামার মাঝে অবস্থিত একটি স্থান হল ফিরায। এখানে রোমানদের বিশাল এক বাহিনীর সাথে খালেদের নেতৃত্বাধীন মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধ হয় এবং মুসলমানরা জয়লাভ করেন আর ১ লক্ষ রোমান সেনা নিহত হয়। এর মাধ্যমে তৎকালীন সবচেয়ে বড় দু’টি পরাশক্তি- রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্য উভয়ই ইসলামের কাছে পরাজিত হয়। আরব সীমান্তে শেষ যুদ্ধ ছিল ফিরাযের যুদ্ধ, এরপর খালেদ (রা.) সিরিয়া অভিমুখে অগ্রসর হন।
খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) আগামী শুক্রবার থেকে অনুষ্ঠিতব্য যুক্তরাজ্য জলসার উল্লেখ করে জলসার সার্বিক সফলতা এবং অংশগ্রহণকারী ও স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য দোয়ার আহ্বান জানান।

Leave a Reply